গোপাল হালদার, পটুয়াখালী:
যে বয়সে কিশোরী শারমিনের বই-খাতা-কলম নিয়ে স্কুলে যাবার কথা, অন্যান্য সহপাঠিদের সঙ্গে করে কৈশর জীবন কাটানোর কথা সে-ই বয়সে লোহার শিকলে বন্দি জীবন কাটাচ্ছে মানসিক ভারসাম্যহীন ও বাক-প্রতিবন্ধী কিশোরী মোসা. শারমিন আক্তার (১২)। গত পাঁচটি বছর শিকলে তালা মেরে রেখেছেন তার অসহায় বাবা-মা।
অথচ একটু ভালো কিংবা উন্নত চিকিৎসা পেলে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারতো কিশোরী শারমিন। কিন্তু অর্থাভাবে শারিমনের সে চিকিৎসাটুকুও করানোর সামর্থ্য নেই তার বাবা-মা’র। যাদের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়ে এবং খেয়ে না খেয়ে চলে জীবন। তাঁর মানসিক ভারসাম্যহীন কিশোরী মেয়ের চিকিৎসার চিন্তা করা তাদের জন্য এক ধরণের বিলাসিতার সমান।
পটুয়াখালী লোহালিয়া নদীর পূর্বপাড়ে লোহালিয়া খেয়াঘাট থেকে আট কিলোমিটার পূর্বে জেলার সদর উপজেলা ও বাউফল উপজেলার সীমান্তবর্তী বাউফলের আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামের মো. আলম মোল্লা ও মোসা. হালিমা বেগমের মেয়ে মো. শারমিন আক্তার। আলম-হালিমার দুই কন্যা সন্তানের মধ্যে শারমিন কনিষ্ঠ। ২০০৯ সালের ১ আগষ্ট শারমিনের জন্ম হয়। জন্মের কিছুদিন পর থেকে শারমিন মানসিক ভারসাম্যহীন ও বাক-প্রতিবন্ধী হয়ে ওঠে এবং বিভিন্ন ধরনের পাগলামী শুরু করতে থাকে। সময়-অসময়ে মারধর করে বাড়ির এবং আশাপাশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের। তাই নিরূপায় হয়ে শারমিনের বাবা-মা তাকে লোহার শিকলে তালা মেরে বেঁধে রেখেছেন। এভাবে গত পাঁচ বছর ধরে লোহার শিকলে বন্দি জীবন কাটাচ্ছে কিশোরী শারমিন। শারমিনের বাবা-মাসহ বাড়ির অন্যান্য লোকজন ও পাড়া প্রতিবেশিরা জানায়, শারমিনের জন্মের পর থেকে এ সমস্যা দেখা দিলেও গত পাঁচ বছর যাবৎ বেশি মাত্রায় পাগলামী শুরু করেছে সে। এ কারণে শিকলে তালা মেরে তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তবে, মাঝে মধ্যে শিকল খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু এতে বড় বিপদ দেখা দেয়। শিকল খুলে দিলেই সে দৌঁড়ে পালিয়ে পায়।
ইতিমধ্যে সে ঢাকা, গলাচিপা, দশমিনা, পটুয়াখালী, বাউফলসহ বিভিন্ন এলাকায় চলে গেছিল। অনেক খোঁজা-খুঁজির পর পাওয়া যায় তাকে। এছাড়া শিকলের তালা খুলে দিলে দৌঁড়ে গিয়ে গাছে ওঠে, খালে কিংবা পুকুরে লাফিয়ে পড়ে এবং বাড়ির অন্যান্য ছেলেমেয়েদের মারধর করে। এতে শারমিনকে নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরতে হয় তার বাবা-মাসহ বাড়ির অন্যান্য লোকজনের। শুক্রবার সকালে সরেজমিনে কাশিপুর গ্রামে শারমিনদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির এক কর্ণারে ছোট্ট একটি টিনের চালা ঘর তাদের। ঘরে মেঝেতে খুঁটিতে হাতে শিকলে তালামারা অবস্থায় বসে আছে কিশোরী শারমিন, পিছনে দাঁড়িয়ে আছে মা হালিমা বেগম। এই শিকলই যেন শারমিনের সারাদিনের সঙ্গী।
সকালে ঘুম থেকে উঠে হাতে শিকল পড়া অবস্থায়ই তার দিন শুরু হয় এবং বিকেল গড়িয়ে অন্ধকার নামে এ অবস্থাতেই। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শারমিনের বাবা মো. আলম মোল্লা বর্তমানে চোখে দেখেন না এবং টাকার অভাবে চোখের চিকিৎসাও করাতে পারছেন না। মা হালিমা বেগমেরও শরীর ভালো না। বারো মাসের ১০ মাসই থাকেন অসুস্থ। কিশোরী মোসা. শারমিন আক্তারের সঙ্গে বার বার কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সে স্পষ্ট কথা বলতে পারে না।