এতদিন A1 এবং A2 দুধ নিয়ে গবেষনার বিষয়টি সবার কাছে দৃষ্টির অগোচরে ছিল । ডেইরী শিল্পে উন্নত দেশগুল, যা মানুষকে জানতে দেয়নি। প্রফেসর কিড উডফর্ড এগ্রি রিসার্স ইউএসএ পত্রিকায় দুধের A1 ও A2 কেজিনের উপস্থিতি নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন there’s a devil in the milk অর্থাৎ যেখানে দুধের ভিতর ভূত। সেটিই আমার আজকের লেখার উপজীব্য তৈরি করেছে। ২০০৯ সালে তিনি বলেছিলেন, A1 ও A2 কেজিন দুগ্ধশিল্পের দুগ্ধ ব্যবসাকে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। বর্তমান সময় পুষ্টি নিরাপত্তার এবং নিরাপদ দুধ উৎপাদনের কথা চিন্তা করে উন্নত দেশসমূহ A2 ব্র্যান্ডের দুধ বাজারজাত করছে; যা সাধারণ দুধের চেয়ে অধিক দামে বিক্রি হয়, যা নিম্মোক্ত লেখচিত্রের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়।
(Source: Bloomberg Market and Finance September 2019)
দুধ স্তন্যপায়ী প্রাণীর স্তন গ্রন্থি হতে নিঃসৃত তরল পদার্থ যা যেকোনো বয়সের মানুষের জন্য আদর্শ খাবার। দুধ ক্যালসিয়াম ও প্রোটিনের অন্যতম উৎস। দুধের প্রোটিনের শতকরা ৮০% কেজিন থাকে। কেজিনকে অনেকগুলো ভাগে ভাগ করা যায়। যা আবার ১৩ প্রকারের হয়ে থাকে ।
A1 বিটা কেজিন ও A2 বিটা কেজিন তার মধ্যে অন্যতম। এই বিটা কেজিনের বিভিন্ন রূপ জেনেটিকালি নির্ধারিত হয় যথা A1, A2, A3, B I C ইত্যাদি। এসব জেনেটিক ভেরিয়েন্ট সমৃদ্ধ A1 বিটা কেজিন হল সমস্যা সমৃদ্ধ কেজিন,যেটাকে দুধের ভেতর ভুত বলা হয়। আমরা প্রতিদিন যে দুধ খাই তাতে A1 বিটা কেজিন এবং A2 বিটা কেজিন দুটোই থাকে। গবেষনায় দেখা গেছে A1 বিটা কেজিন দুধের থেকে A2 বিটা কেজিন দুধ অনেক উপকারী এবং কম ঝুকিপূর্ন।
A1 দুধে স্বাস্থ্য ঝুকিপূর্ন উপাদান Beta Casomorphin 7 ( BCM7) উপস্থিতির কারনেই A2 দুধ সবার কাছে বেশী গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছে।
নিউজিল্যান্ডে A2 দুধ কম্পানিতে ২০০০ সালে ড. করাণ ম্যাকলাচলান একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেন, দুধের প্রোটিনগুলি মানুষকে ভিন্নভাবে প্রভাবিত করে, তিনি উল্লেখ করেছেন যে সাধারণ গাভীগুলি বিভিন্ন প্রকারের বিটা-কেজিন প্রোটিন দুধ উৎপাদন করে, যার নাম A1 এবং A2 বিটা কেজিন, যা ভিন্নভাবে হজম হয়। বছরের পর বছর ধরে গবেষণা করে দেখা যায় যে অনেক লোক যারা সাধারণ গরুর দুধ পান করার সময় অস্বস্তি বোধ করেন তারা কোনো খারাপ দিক ছাড়াই A2 দুধ পান করতে সক্ষম হন। এর কারণ হল A2 দুধে প্রাকৃতিকভাবে শুধুমাত্র A2 প্রোটিন টাইপ আছে এবং A1দুধে নেই।
A1 ও A2 বিটা কেজিনের মধ্যে পার্থক্য উপরোক্ত চিত্রের মাধ্যমে বোঝা যায়। প্রোটিন চেইনে ৬৭ নম্বর পজিশনে A2 বিটা কেজিনে প্রোলিন এবং A1 বিটা কেজিনে হিসটিডিন এমাইনো এসিড থাকে। প্রোলিনের সহিত অল্প BCM7 শক্তভাবে লেগে থাকে পক্ষান্তরে হিসটিডিন এর সহিত BCM7 হালকা ভাবে লেগে থাকে, যা পাকস্থলীতে সহজে মুক্ত হতে পারে এবং মানব শরীরের রক্তে চলে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের অসুবিধা তৈরি করতে পারে। A2 বিটা কেজিন হজম, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং মস্তিষ্কের বিকাশের সহায়তা করে আবার A1 বিটা কেজিন টাইপ-১ ডায়াবেটিস মেলিটাস, কার্ডিওভাসকুলার রোগ,অটিজম এবং সিজোফ্রেনিয়ার মতো অন্যান্য অসুস্থতার জন্য দায়ী।
গবেষনায় দেখা গেছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা,নর্থ ইউরোপের সাদা কালো গরু থেকে যেমন: হলস্টন ফ্রিজিয়ান, আয়ারশায়ার, শর্ট হর্ন থেকে সংকরায়েনের ফলে উৎপাদিত গরুর জাতের দুধে A1বিটা কেজিন বেশি থাকে। বাণিজ্যিক জাতের প্রায় সবগুলোতেই A1 বিটা টাইপের কেজিন থাকে। অন্যদিকে A2 বিটা কেজিন দুধ মূলতঃ বিশুদ্ধ জাতের গরু যেমনঃ গুয়েনসি, গির, শাহীওয়াল ও সিন্ধিতে পাওয়া যায়। হলুদ ও লাল জার্সি গরুতেও A2 বিটা কেজিন দুধ পাওয়া যায়। দেশি গরু, ভেড়া, ছাগল ও মহিষে A2 বিটা কেজিন সমৃদ্ধ দুধ পাওয়া যায়। দেশি জাতের গরুর কুঁজ ও লম্বা সিং থাকে।
দেশি গরুর কুঁজ দিয়ে শরীরে যথেষ্ট পরিমান রোদ প্রবেশ করে। তাই দুধ উপকারী মেডিসিনাল গুণাগুণ সমৃদ্ধ হয় অর্থাৎ ভিটামিন-ডি এর আধিক্য তৈরি হয়। যেহেতু দেশি ও লাল রঙের গরুর দুধ A2 টাইপের,তাই লাল রঙের গরুর চাহিদা ধীরে ধীরে সারা পৃথিবি জুড়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে । এছাড়া সারা পৃথিবীর মধ্যে দক্ষিন এশিয়ায় A2 দুধের গরু বেশী পরিলক্ষিত হয়। খামার পর্যায় নিমোক্ত কর্মসূচির মাধ্যমে A2 মিল্ক তৈরীর পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারেঃ
খামারের প্রাণীসমুহ A1 ও A2 বিটা কেজিন পরীক্ষা করা ক্রস প্রজনন কর্মসূচি বন্ধ করা
বিশুদ্ধ জাতের ষাড়ের বীর্য ব্যবহার করা যা A2 A2 হিসেবে পরীক্ষিত A1 A1 বাছুর তৈরি
A1 A2 গাভী খামার হতে বাদ দেয়া দেশি জাত সংরক্ষণ করা ও লালন পালন বিশুদ্ধ জাতের গরু সংরক্ষণ ও লালন পালন
সিলেকটিভ ব্রীডিং এর মাধ্যমে প্রো-৬৭ অ্যালিল কোডিং এর ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধি করেতে হবে। দুধের মানের অসামঞ্জস্যতা এবং বিশুদ্ধ জাতের সংরক্ষণের জন্য ক্লিনিকাল গবেষণায় সরকারের সহায়তা ও অর্থায়ান প্রয়োাজন।
যদিও বিজ্ঞানীদের মধ্যে A1 ও A2 মিল্ক নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তথাপি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানসহ অনেক দুগ্ধশিল্পে উন্নত দেশসমূহ A2 মিল্ক উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। সাম্প্রতিক সময় নিউজিল্যান্ড, ইউরোপিয়ান বিভিন্ন উন্নত দেশে A1 থেকে A2 ভেরিয়েন্ট এর পরিবর্তনের কাজ চলছে এবং A2 দুধ উৎপাদনে বিজ্ঞানীরা গবেষণায় মনোনিবেশ করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি A2 মিল্কের ভূমিকা নিয়ে প্রকাশ্যে জনসমাবেশে বক্তৃতা দিয়েছেন এবং বিশুদ্ধ জাতের গরুপালনের গুরুত্বের কথা বলেছেন। ২০৪১ সালে আমাদের দেশ উন্নত দেশ হবার রোডম্যাপে আছে; তাই ডেইরি বিজ্ঞানী, প্রাণী প্রজনন ও কৌলি বিজ্ঞানী, পলিসি মেকারদের এ বিষয় ভাবনার সময় এসেছে। আমাদের দেশের বিশুদ্ধ গরুর জাত (যেমন পাবনা, রেড চিটাগাং),মহিষ ও ছাগল থেকে A2 মিল্ক উৎপাদন সম্ভব ।
মিল্ক কোম্পানিগুলো এসব ডেইরি স্পেসিসের মাধ্যমে ডেইরি হাব তৈরি করে দুধ উৎপাদন ও সংগ্রহ করতে পারে। আগামীতে A2 দুধ বাজারজাতকরণের নিমিত্তে গবেষণার কাজকে এগিয়ে নিতে হবে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন শপিংমলে দেশের বাহির থেকে আমদানি করা A2 ব্র্যান্ডের দুধ অধিক দামে বিক্রি হচ্ছে। তাই দেশীয় দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানিগুলোর A2 মিল্ক বাজারজাতকরণের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
লেখকঃ
কৃষিবিদ ডঃ এস.এম. রাজিউর রহমান, পিএইচডি (ডেইরি সায়েন্স)
জাতীয় প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি বিশেষজ্ঞ
জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থা,বাংলাদেশ ।
ই-মেইলঃsmrajiurrahman@yahoo.com