1. admin@upokulbarta.news : admin :
  2. bangladesh@upokulbarta.news : যুগ্ম সম্পাদক : যুগ্ম সম্পাদক
  3. bholasadar@upokulbarta.news : বার্তা সম্পাদক : বার্তা সম্পাদক
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ১২:৪৬ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
ভোলায় দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ আহত- ৩০ সদর উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী ইউনুছ এর পৌর ৩নং ওয়ার্ডে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত সাতক্ষীরায় বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন ভোলা সদর উপজেলা মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান প্রার্থী সালেহা চৌধুরী হাঁস প্রতিকে ভোট চেয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন কবি মিনার মনসুর থেকে আমাদের তরুণদের অনেক কিছু শেখার আছে-রেজাউল করিম চৌধুরী বাইউস্টের শৃঙ্খলা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত ভোমরা শুল্ক স্টেশনের ডেপুটি কমিশনারের দুর্নীতি’র অভিযোগ ইয়ুথ এ্যাডাপটেসন ফোরামের উদ্যোগে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে পানি-খাবার স্যালাইন-মাথার ক্যাপ বিতরণ জাতীয় শ্রমিক দল ভোলা জেলা শাখার উদ্যোগে মহান মে দিবস পালিত রাজশাহীতে জাতীয় দৈনিক মানবিক বাংলাদেশ পত্রিকার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন

মুসলমারদের যে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে

আহসান টিটু
  • আপডেট সময় : রবিবার, ৩০ জুলাই, ২০২৩
  • ৯১ বার পঠিত

মুসলমারদের যে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে

 

আবুল আহসান টিটু

বর্তমানে মুসলিম নতুন প্রজন্মের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা লক্ষ করা যায় যে, জ্ঞান বিজ্ঞানকে উপস্থাপন করতে গিয়ে তারা শুধুমাত্র পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানকে স্বীকার করে। অন্যদিকে মুসলমানদের ঐতিহাসিক গৌরবোজ্জ্বল জ্ঞান বিজ্ঞানের ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে মুসলিম জাতীকে অজ্ঞ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, নৃশংস, পশ্চাদপসরণ জাতি হিসেবে তুলে ধরার প্রবনতা লক্ষ করা যায়!

এটা হয়তো তাদের ঠিক দোষ নয়; বরং তথ্যের অপর্যাপ্ততা বা এ বিষয়ে যথেষ্ট জানতে না চাওয়ার মানসিকতা! এ পরিস্থিতি একদিনে গড়ে ওঠেনি।

পরিকল্পিতভাবে নতুন প্রজন্মকে মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জানতে না দেওয়ার যে পরিকল্পনা রেনেসাঁসের সময় শুরু হয়েছিল, সে পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের ফলেই এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে।

অথচ ঐতিহাসিক সত্য হলো, প্রাচীন ও আধুনিক যুগের মেলবন্ধনের সেতু হলো মধ্যযুগের সভ্যতা ও জ্ঞান বিজ্ঞানকে এগিয়ে নেয় অসংখ্য মুসলিম মনিষী। সে যুগে প্রাচীন গ্রীক ও কনস্টান্টিনোপলের ল্যাটিন বইগুলো সে যুগের মুসলিমরা এবং মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুবাদ ও গবেষণা করা হয়েছিল। সাথে মৌলিক গবেষণায় চিকিৎসা বিজ্ঞান, জ্যোতিবিদ্যা, রসায়ন, পদার্থ বিজ্ঞান, দর্শন, চিত্রকলা, গনিতবিদ্যা ইত্যাদি মুসলমানদের হাতে সমৃদ্ধ হয়ে আধুনিক যুগের প্রবেশদ্বার রেনেসাঁস পর্যন্ত এসেছিল।

তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ লাইব্রেরী ৩টি হলো বাগদাদে দারুল হিকমা, কায়রোয় আল আজহার লাইব্রেরি ও স্পেনের কর্ডোভা লাইব্রেরি। এ জ্ঞান ভান্ডার তিনটিই মুসলিম মনিষীরা গড়ে তুলেছিলেন। তৎকালীন সময় কর্ডোভাকে ইউরোপের ‘লাইট হাউজ’ বা বাতিঘর বলা হতো। স্পেনের শহরে যখন মুসলিমরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পয়ঃনিস্কাশন, পানি সরবরাহ ও রাস্তায় ল্যাম্প পোস্ট ব্যবহার করতো তার একশত বছর পরেও লন্ডনে রাস্তায় বাতির ব্যবস্থা ছিলো না!

মুসলমানদের হাতে গড়ে ওঠা পৃথিবীর অসংখ্য জ্ঞান বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত গ্রন্থগুলির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা জ্ঞানগৃহগুলি পরবর্তীকালে ইউরোপীয়ানদের হস্তগত হলে (বায়তুল হিকমা লাইব্রেরি ব্যতিত, এটা সুর্য উপাসক হালাকু খান কর্তৃক ধ্বংস হয়) তা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো।

যে মুসলিমদের সাধনায় গড়ে ওঠা মধ্যযুগীয় জ্ঞান বিজ্ঞানকে ভিত্তি করে নতুনভাবে গবেষণার মাধ্যমে ইউরোপে রেনেসাঁর উদ্ভব হয়, সে ইউরোপের ভদ্রলোকেরা তাঁদের পূর্বসুরিদের অবদানকে স্বীকার করার মত উদারতা দেখাতে পারেনি কোন কালে!

পৃথিবীর প্রায় সকল অমুসলিম ঐতিহাসিকরা ঐ সকল মুসলিম মনিষীদের নাম বিকৃত করে খ্রিষ্টান বা ইহুদি ঘরনার নামে পরিচিত করার প্রয়াসে ইতিহাসে এমনভাবে (বিকৃত করে) উল্লেখ করেছেন যাতে পরবর্তী প্রজন্ম গৌরবময় মুসলিম ইতিহাস জানতে না পারে!

সত্যি কথা বলতে তারা সেটায় অনেকাংশে সফলও হয়েছে। কারণ, সেই সব মুসলিম মনিষী তথা জ্ঞান পিপাসু বিজ্ঞানীদের কথা আমরা ক’জন জানি!

আজ রসায়ন শাস্ত্র বলতেই যে নামটি সবার আগে আসে তা হল ‘জাবির ইবনে হাইয়ান’। আধুনিক কেমিষ্ট্রি শুরু হয় তার হাত ধরে। এছাড়া পদার্থ বিজ্ঞান, গণিতসহ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাস্ত্রেও ছিল তার অসাধারণ দখল। প্রায় দুই হাজারেরও অধিক গ্রন্থ রচনা করেন এই মহান বিজ্ঞানী। ‘আলকেমি’ শব্দটি তিনিই ব্যবহার করেছিলেন যেই ‘আলকেমি’র ইউরোপীয় ভার্সনই আজকের কেমিষ্ট্রি। মারকাসাইট থেকে লেখার স্থায়ী কালি, ম্যাঙ্গনিজ ডাইওক্সাইড থেকে কাঁচ তৈরির পদ্ধতি, নাইট্রিক এসিড, আর্সেনিক, এ্যান্টিমনি, সিলভার নাইট্রেট, কিউপ্রিক ক্লোরাইড প্রভৃতি সম্পর্কে তার মৌলিক গবেষণা ছিল।

তাছাড়া পাতন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উপাদানের পৃথকীকরণ এবং উর্ধ্বপাতন সংক্রান্ত আলোচনাও রয়েছে তাঁর বিভিন্ন গবেষণাপত্রে। দ্বাদশ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপসহ ততকালীন বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার লেখা বই পড়ানো হতো।

অথচ জাবির ইবনে হাইয়ানকে খ্রিষ্টান ঐতিহাসিকরা পাশ্চাত্য ইতিহাসে “জি’বার” নামে লিখেছে ! যেন নাম দেখে বোঝার উপায় না থাকে তিনি একজন মুসলিম !

মধ্যযুগে ইবনে সিনাই সর্বপ্রথম ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সম্পর্কে মৌলিক চিকিৎসা গ্রন্থ রচনা করেন। মানসিক স্বাস্থ্য এবং শারীরিক ব্যবচ্ছেদ, রোগের জিনগত যোগসূত্র সম্পর্কে তিনিই প্রথম কথা বলেন। তার নামকে ইউরোপীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস বানিয়ে ফেলেছে”এডিসিনা/এভিসিনা”!

আমাদের জানা প্রয়োজন, সে যুগে আবু বকর আল রাযি ছিলেন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানী এবং শল্য চিকিৎসক। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আরেক কিংবদন্তীর নাম হাসান ইবনে হাইসম। তিনি একাধারে চিকিৎসক, পদার্থবিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ। হাসান ইবনে হাইসমই সর্বপ্রথম আধুনিক অপটিকস সম্পর্কে ধারনা প্রদান করেন। তিনি চক্ষু চিকিৎসায় এত বেশি সফলতা অর্জন করেছিলেন যে সমকালিন প্রথাগত চিকিৎসকরা থমকে দাঁড়িয়েছিল। দৃষ্টি বিজ্ঞান বিষয়ক তার রচিত ‘কিতাবুল মানযির’ নামক গ্রন্থটি আজও অমর। তিনি আলোক রশ্মি সাম্পর্কিত গ্রিকদের ভুল ধারণার অবসান ঘটান নুতন গবেষণার মাধ্যমে।

ত্রয়োদশ শতকে পশ্চিম ইউরোপীয় সভ্যতা বিশেষভাবে গ্রহন করেছিল মুসলিম সভ্যতার জ্ঞানের ধারা। তখনকার সময়ের সেক্সট্যাণ্ট নামক আধুনিক যন্ত্র দ্বারা গ্রহ নক্ষত্রের উন্নতি, অবনতি, কৌনিক দূরত্ব পরিমাপ করা হতো; যার আবিস্কারক আল খুজান্তী নামের মুসলিম পদার্থ বিজ্ঞানী। প্রাচীনকালে টলেমির মত বিখ্যাত বিজ্ঞানীরাও বিশ্বাস করতেন যে, কোন বস্তুকে দেখার জন্য চোখই আলোক রশ্মি পাঠায়!

হাজার বছর ধরে চলতে থাকা এ ধারনাকে গবেষণার মাধ্যমে ভুল প্রমানিত করেন মুসলিম বিজ্ঞানী আল হাসান। হাসানই প্রথম গবেষণার মাধমে প্রমান করেন যে চোখ কখনও আলোকরশ্মি পাঠায় না বরং যে কোন উপায়ে আলোকরশ্মি চোখে এসে পরলেই চোখ কেবল বস্তুটি দেখতে পায়।

তিনি ম্যাগনিফায়িং গ্লাসের উত্তল লেন্সকে আধুনিক উত্তল লেন্সের আকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যান। আরেক জন সফল জ্যোতি বিজ্ঞানী ছিলেন ইবনে ইউসুফ। তিনি তার পূর্ববর্তী ২০০ বছরের জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ড পর্যবেক্ষণ করেন এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক একটি সারণি তৈরি করেন। এ সারণির নাম ছিল ‘হাকেমাইট অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টেবল’।

মুসলিম বিজ্ঞানী আল মাসুদী, যিনি History of nature বিষয়ে এনসাইক্লোপিডিয়া রচনা করেন। যার বই পড়ে জ্ঞানার্জন করেছে ইউরোপ! তাঁর নামই পাশ্চাত্য গ্রন্থসমূহে আল মাসুদীর বদলে উল্লেখ করেছে “মারজাকেল” নামে!

Algebra শব্দটি এসেছে ‘হিসব আল জাবর ওয়াল ওয়াল মুকাবাহ’ নামক গ্রন্থটির ইউরোপীয় সংক্ষিপ্ত ভার্সন হিসাবে। যার রচয়িতা মুসলিম বিজ্ঞানী আল খারিযমী। বীজগণিতের ভিত্তিপ্রস্তর রচিত হয় তার দ্বারাই। সমীকরণ সমাধানের প্রায় ছয়টি মৌলিক নিয়ম তিনি আবিস্কার করেছিলেন। তার রচিত বই দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে পড়ানো হতো!

তিনি দশমিকের ব্যবহার, ভারতীয় পাটি গণিত ও বীজগণিতের সমন্বয় সাধন করে উন্নত করেন। আরেকজন সফল মুসলিম গণিতবিদের নাম উমার খাইয়াম। তার ‘কিতাবুল জিবার’ গ্রন্থে দ্বি-ঘাত সমীকরণের সমাধানের পদ্ধতি, সম্পাদ্যসমুহ নিখুঁতভাবে অঙ্কনের পদ্ধতিও বর্ণিত হয়েছে।

বিজ্ঞানী আল বিরুনী কর্তৃক রচিত গ্রন্থে জ্যামিতি ও ত্রিকোনমিতির আধুনিক বিশ্লেষণ এবং পৃথিবীর পরিমাপ সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছিলেন তা আজও প্রতিষ্ঠিত। আল মুকাদ্দাসী, উমার খাইয়াম, হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ প্রমুখ ভুগোল শাস্ত্রের ব্যপক উন্নতি সাধন করেছিলেন।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মুসলিমরা মধ্যে যুগের জ্ঞান বিজ্ঞানের বাহক। এজন্য তারা ল্যাটিন ও গ্রীক ভাষা আয়ত্ব করে প্রাচীন পুস্তকগুলো ফার্সি ও আরবীতে অনুবাদ করেছিলেন। সে জ্ঞানকে তথা ল্যাটিন ও গ্রীগদের অবদানকে তারা অস্বীকার করেননি, বরং শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছেন। কিন্তু মধ্যযুগের মুসলিম জ্ঞান বিজ্ঞানের মুলধনকে পুঁজি করে ইউরোপীয় খ্রিষ্টানরা আধুনিক রেনেসাঁ আনলেও তা স্বীকার করেনি, সুকৌশলে গোপন করেছে! শুধু তাই নয়, যেগুলো গোপন করার উপায় ছিল না, সেগুলো সুকৌশলে উৎস ইতিহাসকে এমনভাবে বিকৃত করেছে যেন মুসলিম শব্দটির কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া না যায়! এমন কিছু মনীষির নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি:

যেমন বিজ্ঞানী আল হাসানের নামকে “হ্যাজেন” লিখছে যাতে ইউরোপসহ বিশ্বের পরবর্তী প্রজন্ম জানতে না পারেন, তারা যে বই (ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত) রেফারেন্স হিসেবে পড়ছে তার রচয়িতা কোন মুসলিম বিজ্ঞানী! তেমনি গণিত বিজ্ঞানী আবু আব্দুল্লাহ্‌ মুহম্মদ ইবনে মুসা আল-খারিজমীকে বিকৃত করে “গরিটাস বা গরিদম”; রসায়ন বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ানকে “জি’বার” উল্লেখ করা হয়েছে!

আবূ ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল কিন্দি ছিলেন ইতিহাস, দর্শন, ভাষাতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে ততকালীন সময়ের সেরা। তার রচিত গ্রন্থগুলো সমসাময়িক সময়ে ল্যাটিন, গ্রিক, হিব্রু ভাষায় অনুবাদ করা হয় এবং ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হতো। পাশ্চাত্য ইতিহাসবিদরা তার নাম বিকৃত করে পরিচিত করেছে “কিন্ডাস” নামে!

তেমনি জাফর ইবনে মুহম্মদ আবু মাশার আল বলখীর নাম বিকৃত করে রাখা হয় “বুসার”; ইউসুফ ইবনে ওমরের নাম ইংরেজি স্টাইলে “উমট”; সাবী আল-বাত্তানীকে “বাতেনিয়াজ”; বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী আবু বকর মুহম্মদ ইবনে যাকারিয়া আল রাজীরের নাম ইউরোপীয় লেখকরা বিকৃত করে “রাসিস বা “রাজিজ” উল্লেখ করেছে! ইবনে রুশদ নামকে “এভেরুন”; চিকিৎসা বিজ্ঞানী আব্দুল মালিক ইবনে জুহুরকে করে “এভেনযোর”; মনোবিজ্ঞানী আবূ নাছের আল ফারাবীকে “ফারাবিয়াস” নামে বিকৃত করা হয়!

দার্শনিক ইবনে আল সাইগ যিনি ইবনে বাজ্জাহ্‌ নামে বেশী পরিচিত তাকে পাশ্চাত্য ইতিহাসবিদরা খ্রিষ্টান নামের সাথে মিল রেখে নাম দিয়েছে “এভেমপেজ”; দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ নুর আদ-দীন ইবনে ইসহাক আল-বেত্‌রুগীকে বিকৃত করে “আলপেটরাজিনাস”; ইবনে মুহম্মদ আল গাজ্জালিকে বিকৃত করে “গ্যাজল”, পদার্থ বিজ্ঞানী আলী ইবনে আব্বাস আল মাজুসীকে “হ্যালী আবাস” নামে রূপ দেন ইউরোপীয় ইতিহাসবিদরা!

এর পিছনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় কারণ ছিলো। মুসলিমরা যখন নতুন নতুন অঞ্চল জয় করে নতুন কৃষ্টি ও সভ্যতার সাথে পরিচিত হচ্ছিল, তখন জ্ঞান পিপাসু একশ্রেণির মুসলিমদের (শুধু আরবীয় নয়) সামনে ছিলো তা দারুণ কৌতুহলের বিষয়! তারা বিভিন্ন অঞ্চলের জ্ঞান আহরণ করে বিন্দু বিন্দু করে বিশাল সিন্ধুতে পরিণত করেন। সৃষ্টি করেন উন্নত সংস্কৃতির। কিন্তু অন্য সব জাতিগোষ্ঠী তাদের সেই পিছিয়ে পড়া প্রাচীন ধারণাকেই আঁকড়ে থাকায় তরুণ খ্রিস্ট অনুসারীরা ইসলাম গ্রহণ না করেও মুসলিম সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেন। এতে প্রভাব কমে যাওয়ার ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে খ্রীষ্টান যাজকেরা!

গবেষণার মাধ্যমে নৌ বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠায় তুলনামূলক উন্নত নৌযানের মাধ্যমে নৌবাণিজ্য মুসলমানদের হাতে চলে যায়। উন্নত সামরিক অস্ত্র ও কৌশলের জন্য অল্প সৈন্য নিয়েও বিশাল সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে থাকায় ইউরোপের খ্রীষ্টান শাসকদের মনে ভীতির সঞ্চার হয়। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য যাজক-শাসক একত্রিত হয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে তথাকথিত ক্রুসেড বা পবিত্র ধর্মযুদ্ধ শুরু  করা হয়! কিন্তু তাতেও মুসলিম অগ্রযাত্রা থামাতে পারেনি তারা।

সামরিক শক্তি ও ধর্মীয় প্রভাব পুণঃউদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে তারা (খ্রিস্টান রাজাগন) একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আর তা হলো, রাষ্ট্রকে ধর্মের থেকে পৃথক করে মুসলিম জ্ঞান বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন গবেষণার মাধ্যমে মুসলিমদের চেয়ে উন্নত সভ্যতা গড়ে তোলার একটি সুদূরপ্রসারী কার্যক্রম। সে সময়ে এটা করতে গিয়ে তারা মুসলিম জ্ঞান বিজ্ঞানকে কাজে লাগালেও মুসলিম শব্দটিকে পরিচিত করাতে চায়নি নতুন প্রজন্মের কাছে। তারা সফল হয়েছেন বৈকি!

অন্যদিকে, ইউরোপিয়ানদের এ অগ্রগতির সময়ে মুসলিম শাসকরা সামরিক, জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণা, শিক্ষা ইত্যাদি খাতে পৃষ্ঠপোষকতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভোগবাদীতা, হটকারিতা, নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে নিজের বৃত্তেই ঘুরপাক খেতে থাকেন। পূর্বপূরুষদের পদাঙ্ক অনুসরণ না করে ষষ্ঠদশ শতকের দুর্বল মুসলিম শাসকেরা নিজেদের অজ্ঞতাকে ঢেকে রাখতে এবং শাসন-শোষণ টিকিয়ে রাখতে মুক্ত জ্ঞানের প্রতি তাদের ভীতি জন্মায়। ফলে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়তে থাকে মুসলিমরা। এ বিপর্যয়ের জন্য মুসলিম শাসকেরা কোন ভাবেই দায় এড়াতে পারে না!

অন্যদিকে, ইউরোপীয় শাসকগণ তাদের ইহুদী ও খ্রীষ্টান জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার কর্মপ্রচেষ্টাকে শ্রদ্ধা জানাতেই হবে। উল্লেখ্য যে, ইহুদি, খ্রিস্টানদের যে মহত্তর কর্মপ্রচেষ্টায় নবযুগের উত্থান ও মানব জাতির যে কল্যাণ সাধিত হয়েছে তা মুসলমানদের কোন ভাবেই ব্যথিত করে না। তাদের এ সফলতাকে প্রেরণা হিসেবে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে মুসলিমরা। ভবিষ্যতে যদি সেটা সত্যিই হয় সেক্ষেত্রে ইউরোপিয়ানদের মত হীনমন্যতায় না ভূগে মুসলিম নতুন প্রজন্ম পাশ্চাত্য সভ্যতার ঋণ স্বীকার করবে আশা করি।

একজন মুসলিম হিসেবে নয়, একজন ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে এ সত্যকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে আলোচনা করেছি। তবে একজন মুসলিম হিসেবে এ স্বপ্ন দেখতে চাই, রেনেসাঁসের কৌশল কাজে লাগিয়ে মুসলিম জাতিও একদিন জ্ঞান বিজ্ঞানে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে ছাড়িয়ে যাবে! মানব কল্যাণে মুসলিমদের বিজ্ঞান গবেষণা পৃথিবীকে পথ দেখাবে!

প্রগতিশীলতার নামে ইসলামকে কটাক্ষ করা, জাতি হিসেবে মুসলিমদের অজ্ঞ হিসেবে চিহিৃত করার মধ্যে কোন মহত্ব নেই। বরং সত্যকে প্রকাশ প্রকাশ্যে আনা, কল্যাণমূলক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সাদরে গ্রহণ, নিরপেক্ষ আত্মসমালোচনার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হওয়াই প্রকারন্তে প্রগতিশীলতা! সত্য হলো- তরবারি নয়; জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন আবিস্কারই নতুনভাবে মুসলিম জাতীকে নিয়ে যেতে পারে গৌরবের স্বর্ণ শিখরে!

 

তথ্যসূত্র :

১। হিস্ট্রি অব দ্যা এ্যারাবস ফ্রম দ্যা আর্লিয়েস্ট টীম টু দ্যা প্রেজেন্ট – ফিলিপ কে. হিট্টি;

২। দ্যা লিটারারি হিস্ট্রি অব পারসিয়া – ই. জি. ব্রাউনো;

৩। ইন্টেলচুয়াল ডেভেলপমেন্ট অব ইউরোপ – ড্রাপার;

৪। এ্যা সর্ট হিস্ট্রি অব দ্যা সারাসেন্স লন্ডন – স্যার আমীর আলী;

৫। দ্যা স্পিরিট অব ইসলাম – স্যার আমীর আলী;

৬। মূর সভ্যতা – ড. এম. এ. কাদের;

৭। উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনের মুসলমানদের ইতিহাস – ড. এম. এ. কাদের ও ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান;

৮। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস – কে আলী ;

৯। আধুনিক মিশরের ঐতিহাসিক বিকাশধারা – মূসা আনসারী;

 

লেখক:

আবুল আহসান টিটু

প্রভাষক, কাজি আজহার আলি কলেজ

ফকিরহাট, বাগেরহাট।

ইমেইল: ahasan.report@gmail.com

এ জাতীয় আরও খবর

ফেসবুকে আমরা