আসন্ন পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক বরিশালে। তৃণমূলের নেতাদের বিভক্তি ও অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেওয়ায় বিপাকে পড়েছেন এই সিটির মেয়র পদে নৌকার প্রার্থী। দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার আগে থেকেই পারিবারিক কোন্দলের গুঞ্জন এবার প্রকাশ্যে আসায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ছে দিনকে দিন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের এই বিভেদের সুযোগ নিতে চায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন নির্বাচনে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোট পাওয়ার পর এবার বরিশালে জয়ের লক্ষ্য নিয়েই মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলটি।
জানা গেছে, মেয়র পদে বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে বাদ দিয়ে তারই আপন চাচা আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাতকে ১৫ এপ্রিলের সভা থেকে নৌকার প্রার্থী করায় কোন্দল প্রকাশিত হয়। এমনকি পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিতেও দ্বিধা করছে না আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত বর্তমান মেয়রপন্থি ভাতিজা সাদিক আব্দুল্লাহ ও আসন্ন নির্বাচনে মেয়র পদে নৌকার প্রার্থী চাচা খোকন সেরনিয়াবাতের অনুসারীরা। অন্যদিকে বিএনপি থেকে নির্বাচিত বরিশাল সিটির সাবেক মেয়র আহসান হাবীব কামালের ছেলে কামরুল আহসান রুপনও আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে। যদি তিনি শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হতে পারেন, তবে আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্বের সুবিধা পেতে পারেন তিনিও। না হলে সিটি নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ও চরমোনাই পীরের মেজো ছেলে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম হতে পারেন খোকনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী।
এ অবস্থায় দ্বন্দ্ব নিরসন করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নৌকার প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে বিজয় নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। এ লক্ষ্যে প্রতিটি সিটি করপোরেশনের জন্য আলাদা আলাদা সমন্বয় কমিটি করছে। সেই কমিটির জন্য খসড়াও কেন্দ্রীয় দপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে। বরিশালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জন্যও আলাদা সমন্বয় কমিটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। শিগগির সেই কমিটি কাজ শুরু করবে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন উপকূলকে বলেন, এই বিভাগে আমাদের একটি সাংগঠনিক প্রতিনিধি দল রয়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটিতে বরিশালের যারা রয়েছেন, তাদের নিয়ে সমন্বয় কমিটি গঠন করে কাজ শুরু করা হবে, প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, মনোনয়নবঞ্চিত বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিক আব্দুল্লাহ কিছুদিন চুপ থাকলেও পরবর্তী সময়ে চাচা খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে রাজধানী থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে নেতাকর্মী-অনুসারীদের দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন; কিন্তু নেতার নির্দেশনার এক সপ্তাহেও জেলা বা মহানগরে সাদিক অনুগত কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে প্রার্থী খোকনের পক্ষে মাঠে দেখা যায়নি। বরং মেয়রপন্থিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সরব থেকে খোকন সেরনিবাতসহ বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের অনুসারীদের বিভিন্ন ইস্যুতে বিতর্কিত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
গত মঙ্গলবার খোকন সেরনিয়াবাত আনুষ্ঠানিক গণসংযোগের সূচনায় সাদিক আব্দুল্লাহ অনুসারীদের সেখানে দেখা যায়নি। নৌকার প্রার্থীর পাশে ছিলেন প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরন ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের অনুসারীরা। ১৬ সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতেও রাখা হয়নি সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারীদের। বিভক্তি আরও প্রকাশ্যে আসে মে দিবসে খোকন সেরনিয়াবাত এবং সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারীদের আলাদা আলাদা কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে। মে দিবস উপলক্ষে তারা পাল্টাপাল্টি সমাবেশ করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, স্থানীয় রাজনীতির এই বিরোধ মেটানো না গেলে চরম খেসারত দিতে হবে আওয়ামী লীগকে। সে ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পেয়ে প্রতিপক্ষ চরমোনাই, জাতীয় পার্টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে এক ধরনের চ্যালেঞ্জে ফেলে দেবে। এতে করে নৌকা প্রার্থীকে বিজয়ী করা অনেকাংশে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।
তবে বিভক্তির বিষয়টি স্বীকার করছেন না বরিশাল আওয়ামী লীগের নেতারা। মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আফজালুল করিম উপকূলকে বলেন, বরিশাল মহানগরের নেতাকর্মীদের মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাতের জন্য নয়, নৌকার জন্য কাজ করতে হবে।
এদিকে নির্বাচনের আগে বরিশালে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ না হলে ভোটের মাঠে চমক দেখাতে পারে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। কারণ বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বরিশালে ধর্মীয় অনুভূতি এবং আবেগে ফেলে এই দলের প্রার্থী (হাতপাখা) মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম ভোটারদের মন কাড়তে চাইবেন। তদুপরি আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব থাকলে এখান থেকেও সমর্থন তাদের পক্ষে কাজ করার ধারণা অমূলক নয়।
ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম গতকাল বৃহস্পতিবার কালবেলাকে বলেন, বরিশাল সিটি নির্বাচন নিয়ে তাদের আলাদা দৃষ্টি রয়েছে, কেননা চরমোনাই পীরের অবস্থান বরিশালে। বরিশালের মানুষ চরমোনাই পীরকে খুব কাছ থেকে দেখে আসছে, তারা আমাদের চেনে। সেখানে আমাদের সংগঠন খুব শক্তিশালী। তবে ভোট সুষ্ঠু হওয়ার ব্যাপারে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বরিশালের মানুষ স্থানীয় নির্বাচনে ভালো নেতা নির্বাচন করতে চায়। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হলে বরিশাল সিটিতে ধারণার চেয়েও বেশি ভোটে হাতপাখা জয়ী হবে ইনশাআল্লাহ।