ছোটবেলায় গ্রামে জন্মদিন পালনের প্রচলন ছিল না বলে ইউনিভাসিটি পর্যন্ত ঘটা করে কেক কেটে আর মোমবাতি জ্বালিয়ে জন্মদিন পালনের মতো বিলাসী বিষয়ে আমার খুব একটা ধারনা ছিল না। ইউনিভাসিটিতে প্রবেশের পর কিছু বন্ধু-বান্ধব বিশেষ করে সদ্য প্রেমে পড়া অথবা প্রেমের আবহ তৈরিতে ডিটারমাইন্ড বন্ধু-বান্ধবদের ঘটা করে কারণে-অকারণে, উপলক্ষে-অপলক্ষে জন্মদিন পালনের উৎসব দেখে এই দিনটি উৎযাপনের উন্মাদনা মাঝে মাঝে আমার অতৃপ্ত মনকে ছুয়ে যেতো কিন্ত বাস্তবতার বেড়াজালে তা কখনোই পালন করা হয়ে উঠেনি। এভাবেই এই উৎসব পালনের উম্মাদনা ধীরে ধীরে মনের গভীরে বিলীন হতে থাকে যা পরিবর্তীতে কখনোই আমাকে তাড়া করতে পারেনি। সেই কারনেই এই দিনটি উৎযাপন কখনোই সেইভাবে আমাকে টানেনি।
সময় বদলে গেছে, পরিবেশও বদলে গেছে, সাথে সাথে আমিও সময়ের চাহিদার প্রেক্ষিতে বদলে গেছি। বাবা হওয়ার পর নিজের ছেলে-মেয়েদের জন্মদিন কেন্দ্রীক উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখে প্রতি বছরই তাদের জন্মদিন আসলে সাধ্যের মধ্যে তাদের জন্য ঘরোয়া পরিবেশে কিছু একটি উৎযাপনের চেষ্টা করি। এই ছোটখাটো উৎযাপনই তাদের কতোটা যে আনন্দ দেয় তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। তাদের চোখে মুখে এই আনন্দের অভিব্যক্তি দেখতেই আমাদের এই আয়োজন। বরাবরের মতোই গতকাল ছিল আমার ছোট মেয়েটার ৪র্থ জন্মদিন।
আমার ছেলে-মেয়ে দুটোর মধ্যে মেয়েটার প্রতি কেন জানি একটু বেশিই টান অনভুব করি। যে টানটা ছোটবেলা থেকেই আমার বাবার চেয়ে মায়ের প্রতি অনুভব করতাম। হয়ত অধিকাংশ বাবাই আমার মতো অনুভব করে। কন্যা সন্তানের প্রতি যে টানের কথা রাসুল (সা.) বলে গেছেন, যা বিভিন্ন হাদিসেও এসেছে।
জানা যায় রাসুল (সা.) মেয়েদের অনেক বেশি ভালোবাসতেন। মেয়েরা ছিল তার আদরের দুলালী। আজীবন তিনি কন্যাদের ভালোবেসেছেন এবং কন্যা সন্তান প্রতিপালনে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং কন্যা সন্তান লালন-পালনে অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দু’টি কন্যাকে তারা সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করবে, কিয়ামতের দিন আমি এবং সে এ দু’টি আঙ্গুলের মতো পাশাপাশি আসবো (অতঃপর তিনি তার আঙ্গুলগুলি মিলিত করে দেখালেন)’। (মুসলিম, হাদিস নং: ২৬৩১, তিরমিজি, হাদিস নং: ১৯১৪, মুসনাদ আহমদ, হাদিস নং: ১২০৮৯, ইবনু আবি শাইবা, হাদিস নং: ২৫৯৪৮)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলনে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করনে, ‘যার ঘরে কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলো, অতঃপর সে ওই কন্যাকে কষ্ট দেয়নি, মেয়ের ওউপর অসন্তুষ্টও হয়নি এবং পুত্র সন্তানকে তার ওপর প্রধান্য দেয়নি, তাহলে ওই কন্যার কারণে আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে প্রবশে করাবেন। ’ (মুসনাদ আহমদ, হাদিস নং: ১/২২৩)
হযরত আবদুল্লাহ উমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ওই নারী বরকতময়ী ও সৌভাগ্যবান, যার প্রথম সন্তান মেয়ে হয়। কেননা, (সন্তানদানের নেয়ামত বর্ণনা করার ক্ষেত্রে) আল্লাহ তায়ালা মেয়েকে আগে উল্লেখ করে বলেন, তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন, আর যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। ’ (কানযুল উম্মাল ১৬:৬১১)
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘কারও যদি তিনটি মেয়ে কিংবা বোন থাকে অথবা দু’টি মেয়ে বা বোন থাকে, আর সে তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে এবং তাদের সঙ্গে সদাচার করে, তবে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে। ’ (মুসনাদ আহমদ, হাদিস নং : ১১৪০৪; আদাবুল মুফরাদ লিল-বুখারি: ৭৯)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যার তিনটি কন্যাসন্তান থাকবে এবং সে তাদের কষ্ট-যাতনায় ধৈর্য ধরবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (মুহাম্মদ ইবন ইউনূসের বর্ণনায় এ হাদীসে অতিরিক্ত অংশ হিসেবে এসেছে) একব্যক্তি প্রশ্ন করলো, হে আল্লাহর রাসুল, যদি দু’জন হয়? উত্তরে তিনি বললেন, দু’জন হলেও। লোকটি আবার প্রশ্ন করলো, যদি একজন হয় হে আল্লাহর রাসুল? তিনি বললেন, একজন হলেও। ’ (বাইহাকি, শুয়াবুল ঈমান : ৮৩১১)
সন্তান-সন্ততি (ছেলে-মেয়ে উভয়েই) আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত ও শ্রেষ্ঠ উপহার। ইসলাম উভয়কেই আলাদা সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে। কাউকে কারও থেকে ছোট করা হয়নি কিংবা অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়নি। কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো অনেক পরিবারে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে ইতিবাচক চোখে দেখা হয় না। অনেকে আবার মেয়ে সন্তানের মায়ের ওপর নাখোশও হন। এমনকি লালন পালনের ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা যায়। এমন কি সম্পদি দেয়ার ক্ষেত্রেও চরম বৈষম্য দেখান। পরিচিত অনেক কথিত ভালো বাবাকেও দেখেছি সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে বা প্রাপ্য অনুযায়ী দেয়নি। অথচ এমন কাজে আল্লাহ তাআলা ভীষণ অসন্তুষ্ট হন, যা কোরআন ও হাদিসে বিভিন্নভাবে বর্ণিত আছে।
কন্যা সন্তানের গুরুত্বের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার মুখ অন্ধকার হয়ে যায় এবং অসহ্য মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে। তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে থাকে। সে ভাবে, অপমান সহ্য করে তাকে থাকতে দেবে নাকি তাকে মাটির নিচে পুতে ফেলবে। শুনে রাখো, তাদের ফয়সালা খুবই নিকৃষ্ট। ’ (সুরা আন-নাহল, আয়াত : ৫৮-৫৯)
সুতরাং আল্লাহতায়ালা যেন তার উপহার স্বরুপ তার দেয়া বিধান অনুযায়ী আমাকে আমার রাজকন্যাকে লালন-পালনের তৌফিক দান করে এবং আমার মতো পৃথিবীর সব বাবাকেই তাদের রাজকন্যা লালন-পালনের তৌফিক দান করে সেই প্রত্যাশাই করি আমার মেয়ের জন্মদিনে।