ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক অধ্যাপক রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছেন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অনুষ্ঠানে এসেছে। অনুষ্ঠান শেষে গেটের বাইরে বেরুতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। বাধ্য হয়ে অধ্যাপক গেটের পাশে ছাউনিতে দাঁড়িয়ে থাকলেন। অপেক্ষা করছেন। বৃষ্টি কমলে তবেই যাবেন। কিছুক্ষণ পর গ্যারেজ থেকে একটি দামি প্রাইভেট কার বের হয়ে অধ্যাপকের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। গাড়ির দরজা খুলে একজন নেমে এসে স্যারের পা ছুঁয়ে সালাম করলেন।
স্যার বললেন, আমি কিন্তু আপনাকে ভালোভাবে চিনতে পারিনি বাবা!
ছাত্রটি ব্যস্ত হয়ে বললো, স্যার আমি আপনার অমুক ব্যাচের ছাত্র, আমার নাম এই। আমি অমুক সচিবালয়ে অমুক দায়িত্বে আছি।
স্যার বললেন, আচ্ছা, খুব ভালো। খুশি হলাম।
ছাত্র বললো, স্যার দাঁড়িয়ে আছেন যে? কারো অপেক্ষায় আছেন?
স্যার বললেন, হ্যাঁ, বৃষ্টি কমার অপেক্ষায়। ছাত্র একটু অবাকের ভঙ্গিতে বললো, বলেন কী স্যার! আপনার প্রাইভেট গাড়ি নাই?
স্যার শুধু বললেন, না, নেই।
ছাত্র বললো, স্যার আমার ব্যক্তিগত আরও একটা গাড়ি আছে। আপনি অনুমতি দিলে আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে।
শিক্ষক বললেন, তা লাগবে না। এদেশের শিক্ষকরা কদমবুসি নিয়েই বেঁচে থাকে।
(অধ্যাপক আনিসুজ্জামান : স্মৃতিপটে আলোময় মুখখানি)
এতো গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কথা। কিন্তু এদেশের প্রায় ৯০ ভাগ শিক্ষা যাদের শ্রমে তাদের অবস্থা কি? সত্যি বললে, তাদের অবস্থা অনেকটা গার্মেন্টস শ্রমিকদের মতো। কোন কোন ক্ষেত্রে তার চেয়েও শোচনীয়। এরাই এমপিওভূক্ত শিক্ষক। কিছু কোচিং বা প্রাইভেট আসক্ত শিক্ষক বাদ দিলে দেশের প্রায় ৫ লাখ এমপিওভূক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের অবস্থা অনেকটা একই রকম।
কিন্তু দুখের বিষয় হচ্ছে যারা এসব শিক্ষকদের কাছে লেখাপড়া শিখে আজ সমাজের প্রভাব প্রতিপত্তি পেয়েছেন তারা কদাচিৎ তা মনে করেন। গুরুদক্ষিণার বদলে এমপিও শিক্ষকতাকে অনেকটা তৃতীয় শ্রেণির পেশা হিসেবে বিবেচনা করেন। ব্যক্তিগত নয়, বরং রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা, অধিকার থেকে বঞ্চিত করতেও যেন তাদের আনন্দ!
শিক্ষকরাও এ সমাজে বাস করে। তাদেরও অন্যদের মতো ক্ষূধা লাগে। তাঁরও স্ত্রী সন্তানদের একটু ভালো রাখার ইচ্ছে হয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে তাদের বাজার করতে অসুবিধা হয়। হয়তো পেশাটা শিক্ষক হওয়ায় বাজেট কাট-ছাট করে অর্ধাহারে দিন কাটালেও কেউ জানে না।
পাগলা ঘোড়ার মতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ায় সরকার মূল বেতনের উপর ৫% প্রণোদনা দিয়েছে। সরকারি কর্মচারীরা আগামী ১ জুলাই থেকে এই ৫ শতাংশ প্রণোদনা পাচ্ছেন। ওই সময়ে বার্ষিক ৫ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের সঙ্গে আরও ৫ শতাংশ প্রণোদনা যোগ হচ্ছে। অর্থাৎ তারা জুলাই মাসের বেতনের সঙ্গে মোট ১০ শতাংশ বাড়তি অর্থ পাবেন। কিন্তু এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকার থেকে এই ৫ শতাংশ বাড়তি প্রণোদনা পাচ্ছেন না! মনে হচ্ছে- ইচ্ছে করেই তাদের প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
দৈনিক শিক্ষায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক) সোনা মণি চাকমা বলেন, সরকারি কর্মচারীদের মতো এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়তি ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেয়ার ব্যাপারে এখনো আমরা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নির্দেশনা পাইনি। ফলে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত আমরা তাদের প্রণোদনা দিচ্ছি না।
সবসময় বলা হয় এমপিওভূক্ত শিক্ষকদের সরকার শতভাগ বেতন দেয়। ধরুন ৯ম গ্রেডের একজন সরকারি চাকরিজীবীর বেসিক ২২ হাজার টাকা। এর সাথে ঘরভাড়া, মেডিকেল দিয়ে (এলাকা ভেদে কিছুটা কমবেশি হলেও) গড়ে ৩৫ হাজার ৬০০ টাকা মাসিক বেতন গ্রহণ করেন। এছাড়া অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন তাঁরা।
অন্যদিকে একই গ্রেডের একজন এমপিওভূক্ত শিক্ষকের ২২ হাজার টাকার বেতন দিয়ে তা থেকে (কল্যান তহবিল ও অবসর তহবিলে) বাধ্যতামূলকভাবে ১০% কর্তন করে রাখে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এর সাথে মাত্র ১ হাজার টাকা ঘরভাড়া ও ৫০০ টাকা মেডিকেল দেওয়া হয়। ফলে একজন একই গ্রেডভূক্ত এমপিও শিক্ষক মাসিক বেতন পান মাত্র ২১ হাজার ৩০০ টাকা।
একজন সরকারি চাকরিজীবী ঈদ-কোরবানিতে বেসিকের সমান ২টি উৎসব ভাতা পান যার পরিমান ৪৪ হাজার টাকা। অন্যদিকে একজন এমপি শিক্ষক ঈদ ও কোরবানিতে মূল বেতনের ৪ভাগের ১ভাগ উৎসব ভাতা পান যা মাত্র ৫হাজার ৫শ টাকা। একজন এমপিওভূক্ত সহকারি শিক্ষক কোরবানিতে বোনাস পান মাত্র ৪ হাজার টাকা! শিক্ষকদের সরকার শতভাগ বেতন দেয় বললেও এসব কথা কেউ বলে না!
শিক্ষকদেরও তো ছোট ছোট বাচ্চা আছে! শিক্ষকতার বাইরেও তো সে একজন পিতা। একজন সরকারি শিক্ষক যে বই পড়িয়ে রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধা নেয়, সেই একই বই পড়িয়ে একজন এমপিও শিক্ষক রাষ্ট্রের কাছে এত অবহেলিত থাকবে কেন?
যদি বলেন, তারা বেশি যোগ্য, মেধাবী তাই তারা ওই সুবিধা নিচ্ছে। আপনি এমপিও শিক্ষক কম যোগ্যতা তাই বৈষম্যটা ঠিকই আছে।’ তর্কের খাতিরে আপনার কথাটা যদি ঠিক ধরেও নেই তাহলে আমার প্রশ্ন- কম যোগ্যতা সম্পন্ন এমপিও শিক্ষক কেন সমানভাবে একই বই, একই কারিকুলাম সমপরিমান কাজ সম্পাদন করবে? যেহেতু সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকরা সমান কাজ করেন এবং সরকারি কলেজের চেয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো ফলাফল উপহার দিয়ে থাকেন তাই এ বৈষম্য অচিরেই দুর করা হোক।
শিক্ষকরা এই সমাজেই বাস করে। তাদের সন্তানদেরও সমাজে আপনার সন্তানের মতো মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। অসুখ হলে তাদেও চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। ক্ষূধা লাগলে খেতে হয়। তাই শিক্ষকরা আজ শুধু কদমবুচি নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় না। শিক্ষায় যারা নীতি নির্ধারণ করেন তাদের প্রতি আহব্বান জানাই। এমপিও শিক্ষকরা আপনাদের দয়া চায় না, রাষ্ট্রের থেকে ন্যায্য অধিকার চায়। আপনারা বিচারক হিসেবে ন্যায় বিচার করবেন এটাই আশা করি।
বেসরকারি শিক্ষকরা একটি খারাপ সময় পার করছে। আজ জাতীয় দৈনিক ভোরের ডাক পত্রিকার সংবাদ- অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কারও সময়মতো অবসরভাতার সুবিধা পাওয়ার রেকর্ডও নেই। অবসরের টাকার জন্য অপেক্ষা করতে করতে সম্প্রতি ঠাকুরগাঁও, কুমিল্লা, রংপুর ও বরিশালের কয়েকজন শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। অর্থের অভাবে চিকিৎসা না পেয়ে তারা মারা গেছেন।
জানা গেছে সারাদেশে একাধিক শিক্ষক ক্যান্সারে ভুগছেন। টাকার অভাবে তারা চিকিৎসা চালাতে পারছেন না। আ হ ম শফীউল্লাহ হাজারী নামে এক শিক্ষক বলেন, আমি কষ্টে আছি এবং আমার চিকিৎসা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। আমি গত ৩৫ বছর ধরে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়তে ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু এখন অসহায়, চরম কষ্টে সময় পার করছি।”যাদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছি তাদের কাছেই ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে অবসর তহবিলের টাকার জন্য।
আরেকটি পত্রিকায় লিখেছে- মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীনে ভূমিকা রাখেন নরসিংদীর সিরাজুল ইসলাম। স্বাধীনতাত্তোর শিক্ষিত জাতি গঠনে তিনি যোগ দেন শিক্ষকতা পেশায়। নরসিংদী পৌর এলাকার মীর ইমদাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে দীর্ঘ দিন কর্মরত থাকার পর ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর অবসরে যান তিনি।
অবসরভাতার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডে আবেদন করেন। কিন্তু অনেক দিন দেন দরবারের পরও তার ভাগ্যে জোটেনি সে টাকা। অনেকটা অর্থ সংকটে বিনা চিকিৎসায় এই মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলেও আজও তার পরিবার টাকা পায়নি।
একই জেলার চৈতণ্য উচ্চ বিদ্যালয়ের নৈশ প্রহরী মো. কাজল মিয়া চাকরিরত অবস্থায় মারা গেলে তার স্ত্রী আখিনুর স্বামীর অবসর ভাতা তোলার জন্য আবেদন করেন। ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর আবেদন করলেও আজও তার স্বামীর প্রাপ্য টাকা তুলতে পারেননি। অথচ দীর্ঘ চাকরি জীবনে তারা যে এমপিও পেয়েছেন, সেখান থেকে এই তহবিলের জন্য প্রতি মাসে ৪ শতাংশ টাকা কেটে রাখা হয়েছে। অবসরভাতা তোলার জন্য বর্তমানে প্রায় ৪৭ হাজার শিক্ষক দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
প্রতিদিন ভোগান্তির শিকার শত শত শিক্ষকের ভিড়। তাদের কেউ কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা-মাতা। কেউ বয়সজনিত নানা রোগে আক্রান্ত। শেষ বয়সে উপার্জন বন্ধ হওয়ায় এসব শিক্ষকের অনেকে অনাহার-অর্ধাহারেও দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু অবসর ফান্ডের জন্য নিজের বেতন থেকে কেটে রাখা টাকা তুলতে পারছেন না।
এভাবে শিক্ষকরা শুধু কদমবুচি নিয়ে বাঁচতে চায় না। তবু একটা আমলাতান্ত্রিক খারাপ রাষ্ট্রীয় কাঠামের মধ্যে শিক্ষকরা বেঁচে থাকে, থাকতে বাধ্য হয়।
আহসান টিটু
২৭ জুন, ২০২৩ খ্রি.
ইমেল: ahasan.report@gmail.com