অনেক দিন গল্প করা হয়না। চলুন আজকে হালকা মেজাজের গল্প করি। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই৷ জোসেফ স্টালিনের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ছিলেন। বলা হয়, ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী স্টালিন৷ গুমের মাস্টারমাইন্ড৷ এদের মধ্যে দলের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে তার ঘনিষ্ঠ লোকজনও ছিলেন। কাউকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার তার একটা নিজস্ব তরিকা ছিল। যাকে দুনিয়া থেকে সরাতেন তাকে সব জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলতেন। যেহেতু অনেকে তার খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তাদের সাথে ছবি ছিল। পরে ছবি থেকেও তাদের মুছে ফেলা হতো। এরকম একটি ছবিতে দেখা যায় স্টালিনের সাথে তিনজন দাড়িয়ে রয়েছেন। প্রথমে সেই ছবির একজনকে মেরে ফেলা হয়। ছবি থেকেও তাকে মুছে ফেলা হয়। এক পর্যায়ে ছবিতে শুধু স্টালিনই বাকী থাকেন। বলছিলাম মজার গল্প করবো। অথচ খুন খারাবি নিয়ে শুরু করছি। এগুলো তো মজার কোন বিষয় নয়। তবে কাছের লোকজনের কে শত্রু; কে মিত্র তা বাছাই করতে স্টালিনের কৌশল নিয়ে বাজারে অদ্ভূত মজার গল্প প্রচলিত রয়েছে। চলুন এর একটি গল্প শুনে আসি৷
একবার স্টালিন গোয়েন্দা সূত্রে খবর পেলেন, দলের শীর্ষ নেতা ও তার ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে আমেরিকার সিআইএর এজেন্ট রয়েছে। ব্যক্তিটি সম্পর্কে অার কোন সুষ্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। কে সেই গুপ্তচর তা খুঁজতে এক কৌশলের আশ্রয় নিলেন স্টালিন। তিনি দলের শীর্ষ নেতাদের ডাকলেন। দুপুরে তাদের সবার জন্য লাঞ্চের বিরাট আয়োজন করলেন। সবাই খাওয়া দাওয়া করেন। পরে স্টালিন তাদের নিয়ে বৈঠক শুরু করেন। আর বিষয় হিসেবে বিদেশের সাথে কৌশলগত সম্পর্কের জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। একেতো সবাই দুপুরের খাবার বেশি খেয়ে ফেলেছেন, অন্যদিকে জটিল বিষয়। সবার চোখে ঘুমঘুম ভাব। কেউ কেউ ঢলে পড়ছেন। কেউ স্টালিনের সামনে ভয়ে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। স্টালিন তা তীক্ষ্ণ নজরে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। একপর্যায়ে স্টালিন অামেরিকার প্রসঙ্গে কধা বলা শুরু করেন৷ একজনের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেলো৷ তার চোখে ঘুম নেই৷ তিনি খুবই মনযোগ দিয়ে আগ্রহ সহকারে শুনতে শুরু করেছেন। স্টালিনের আর বুঝতে বাকী থাকেনি কে হতে পারে সিআইএর এজেন্ট। তাকে ঘিরে সব ধরণের গোয়েন্দা তদন্তের নির্দেশ দিলেন। একসময় সিআইয়ের সাথে ওই শীর্ষ নেতার যোগাযোগের বিষয়টি ধরা পড়ে। স্টালিন তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলেন। সব ধরণের ছবি থেকেও তাকে মুছে ফেলা হয়।
আরবীতে একটি প্রবাদ রয়েছে- দেহকুল হাকিমি লা ইয়াখলু আনিল হিকমাহ। হাকিমের হাসি কোন কৌশল থেকে খালি নয়। অর্থ্যাৎ হাকিম হাসি দিলে এর পেছনে কোন কারণ বা গুরুত্ব থাকে। না হেসে মুখ গম্ভীর রাখলেও তার কারণ নিহিত থাকে। ধরুন, কোন জায়গায় কয়েকজন লোক অাড্ডা দিচ্ছেন। সবাই হাসছে। শুধু একজনের মুখ গম্ভীর। আপনি নিশ্চিত থাকুন- সেখানে অন্য কোন ঘটনা লুকিয়ে রয়েছে।
একটা অফিসে বড় স্যার কৌতুক বলছেন। জুনিয়র কর্মকর্তারা শুনছেন৷ সিনিয়র স্যারেরা কৌতুক বললে জুনিয়রদের সাধারণত হাসতে হয়। এটাই সায়েন্স৷ তা যে ধরণের কৌতুকই হোকনা কেন! হাসি না আসলে অঘোষিত বিপদ। দেখা গেলো- কৌতুক শুনে একজনের মুখে হাসি নেই। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো-সবাই হাসছে। তোমার মুখে হাসি নাই কেন। তিনি বলেন, আসলে আমার আরেকটি চাকরি হয়ে গেছে।
গোপাল ভাঁড়েরও গল্পটা শুনি। একবার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়িতে চুরি হয়েছে। চোর ধরার দায়িত্ব পড়েছে গোপালের ওপর। রাজবাড়ির সন্দেহভাজন লোকজনকে ডাকা হলো। সবার সামনে গোপাল ভাঁড় রাজাকে বললেন, আমি চোর ধরে দেবো। তাকে কী সাজা দেবেন। রাজা চোরের ভয়াবহ শাস্তির কথা বলতে লাগলেন। আর ওই দিকে তার সামনে দাড়িয়ে রয়েছে চোর৷ ভয়ে বেচারার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। বারবার ঢোক গিলতে থাকে। গোপাল তা লক্ষ্য করেন। তবে কেউ ঢোক গিলতে থাকলে তো আর তাকে চোর বলা যায়না। গোপাল বৃদ্ধি আটঁলেন। বললেন, শুকনা আটা আনা হোক। সবাইকে এই আটা থেকে এক মুঠো আটা নিয়ে থুথু দিয়ে খামির বানাতে হবে। যে খামির বানাতে পারবেনা- সেই চোর। দেখা গেলো- শাস্তির বর্ণনা শুনে ভয়ে চোরের গলা শুকিয়ে গিয়েছিলো। তার মুখ থেকে থুথু আর বের হয়না। সে থুথু দিয়ে আটার খামির বানাতেও ব্যর্থ হয়। চোর ধরা পড়ে যায়।
যাই হোক, একজন তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে এই গল্পটা শুনছিলাম। এক বাড়িতে একজন খুন হয়েছে। পুলিশ গেছে, তদন্ত করতে। সবার মনে শংকা। সবাই শোকে আচ্ছন্ন। তবে বাড়ির একজন খুব উৎসুক। সবার চেয়ে তার মধ্যে শোক বেশি। তদন্তকারী কর্মকর্তা তার বিষয়ে সতর্ক হলেন। নজরে নজরে রাখলেন৷ একসময় দেখা গেলো বেশি শোক দেখানো লোকটিই আসলে খুনী।
লেখাটা দীর্ঘ করতে চাইনা। উপরের গল্পের সাথে সম্পর্কিত হওয়ায় এ গল্পটা না বললেই নয়। একবার এক পুলিশ কর্মকর্তার বউ গুলিতে মারা যান। পুলিশ কর্মকর্তা কর্মস্থলের বাইরে ছিলেন। তিনি ফিরে এসে বললেন, জঙ্গীরা তার বউকে গুলি করে মেরে ফেলেছেন। সামাজিক মাধ্যমে সবার প্রতিক্রিয়া শুরু হয় । তবে আমার নজর এসব দিকে ছিলনা৷ নজর ছিল যার বউ মারা গেছে তার দিকে। বউ মারা যাওয়ার পর তার কান্না দেখে আমি তো হতবাক৷ কারণটা বলছি৷ একবার একটা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্ন করা হয়েছিল- অভাগার গরু মরে, ভাগ্যবানের বউ মরে- এর তাৎপর্য কী! উত্তরে কতকিছু লিখেছিলাম৷ এ কারণে বিষয়টি আমার মনে গেঁথে গেছে। নকুল বিশ্বাস এই প্রবাদের ওপর উপর ভিত্তি করে একটি গানও লিখেছেন। বউ মরে গেলে দুইদিন কান্না/ তিনদিন বন্ধ রান্না/ স্বামী চারদিন ভালো করে খান্ না/পাঁচ ছ’দিন শোকের ঢেউ/ সাতদিনের পরে, আনে আবার ঘরে/ নতুন একখান বউ/ স্বামীকে বিশ্বাস করো না কেউ।
বউ মারা গেলে পুরুষ মানুষের নাকি খুশী হওয়ার কথা৷ তবে লোকে কী ভাবতে পারে- তা ভেবে হয়ত একটু আধটু শোক প্রকাশ করতে হয় বৈ কি! সেখানে বউয়ের জন্য ওই স্বামীর সে কী কান্না! আমি জীবনে বহু মানুষের বউ মারা যেতে দেখেছি। তাদের অনেকে বউকে অনেক ভালোও বাসতেন। কিন্তু বউ মারা গেলে এমন কান্না করতে আর কাউকে দেখি নাই। বেচারা দাড়াতে পারছিলেন না৷ কয়েকজনকে ধরে ধরে হাটছেন৷ যে বা যারা সান্ত্বনা দিতে গেছেন তাদের ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন৷ আমার আশপাশে যারা ছিল তাদেরকে বলে দিয়েছিলা
তাদেরকে বলে দিয়েছিলাম, হয়-বউয়ের জন্য এই কান্না, এই শোক পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। নয়তো- এই কান্না মামলার ভালো একটা ক্লু হবে। যাই হোক বহু জোয়ার ভাটার পর ওই কর্মকর্তা চাকরি হারিয়েছেন। বাদী থেকে আসামী হয়েছেন। মামলা চলছে। বাকীটা আদালতের উপরে। এই ঘটনা আমার বিষয় নয়৷ আমার লেখার বিষয়টা হলো- বউয়ের জন্য অতিশোক৷ অতি কান্না৷
তার মানে কোন ঘটনায় হাসি কান্নারও গুরুত্ব রয়েছে। হাসি কান্না ঘটনার বড় ক্লু হতে পারে৷ সেটা অতিরিক্ত হলে তো কথাই নেই৷ যারা তদন্ত করেন- এ বিষয়গুলো ভালো করেই পর্যবেক্ষণ করেন।
অতিরিক্ত বা অতি কম দুটোই সন্দেহের কারণ বটে।
Kazi Saemuzzaman
৩১ মে ২০২৩
ঢাকা৷